স্প্যানিশ ফ্লু আক্রান্তের শুরুর কথা
স্প্যানিশ ফ্লুর প্রথম স্ট্রেনটি তেমন একটা মারাত্মক ছিল না। তারপরেও এটি তার পূর্ণ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ফিরে এসেছিল।
১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারীর ভয়াবহতা সে সময় “স্প্যানিশ ফ্লু (spanish flu)” হিসাবে পরিচিত ছিল। এটি কেন এতো ভয়াবহ হয়েছিলো তা জানা শক্ত। তবে ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী ৫০ কোটির বেশি মানুষকে সংক্রামিত করেছিল এবং আনুমানিক ২ থেকে ৫ কোটি ভিকটিমকে হত্যা করেছিল। ফ্লুতে হতাহতের সংখ্যাটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত সকল সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকের চেয়েও বেশি ছিল।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়া মহামারীটি দু’বছর স্থায়ী হয়েছিল। ১৯১৮ এর শরত্কালে সিংহভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সে সময়ের প্রথম তিনটি মাস বিশেষত ইতিহাসের একটি নির্মম সময়ে পরিণত হয়েছিল।
ভাইরাসটি এতোটা ভয়ংকর কেন হয়েছিলো?
সে বিষয়ে অনেক মতামত পাওয়া যায়, তবে বেশিরভাগ ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন যে, স্প্যানিশ ফ্লুর “দ্বিতীয় আঘাত” এতো মারাত্মক হওয়ার কারন হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে যুদ্ধকালীন সৈন্যবাহিনীর বিশ্বব্যাপী বিচরন অব্যাহত থাকা। আসলে তীব্র একটি মিউটেশন ভাইরাস প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ঘরে ফেরা সৈন্যদের দ্বারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল, ফলে এটি আরও অনেক বেশি প্রাণঘাতী হয়েছিলো।
১৯১৮ সালের মার্চ মাসের গোড়ার দিকে স্প্যানিশ ফ্লু যখন প্রথম দেখা দেয়, তখন এটির একটি অতি সংক্রামক এবং ভাইরাস জনিত চাপ থাকলেও, এর বৈশিষ্ট্য ছিল অনেকটাই মৌসুমী ফ্লুর মতোই।
প্রথম যে রোগীটি চিহ্নিত হয়, তার নাম ছিল আলবার্ট গিচেল, যিনি ক্যানসাসের ক্যাম্প ফানস্টনে মার্কিন সেনাবাহিনীর কুক ছিলেন। প্রথমে তিনি ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকেই মূলত সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সে সময় সেখানে ৫৪,০০০ সেনা অবস্থান করছিল।
সেখানে, মার্চ মাসের শেষের দিকে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় ১,১০০ সেনা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, যার মধ্যে ৩৮ জন মারা গিয়েছিল।
এ ঘটনার প্রাথমিক কারন ছিল মার্কিন সেনারা ইউরোপে যুদ্ধের সময় কোনভাবে আক্রান্ত হয়েছিলো এবং দেশে ফেরার সময় তারা স্প্যানিশ ফ্লুকেও সাথে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯১৮ সালের এপ্রিল ও মে মাস জুড়ে এই ভাইরাসটি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন এবং ইতালি জুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
১৯১৮ সালের বসন্তের মধ্যে আনুমানিক তিন-চতুর্থাংশ ফরাসী সামরিক বাহিনী, এবং প্রায় অর্ধেক ব্রিটিশ সেনা সংক্রামিত হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে, ভাইরাসটির প্রথম আঘাত সেভাবে মারাত্মক ছিল না। সাধারণত একটু বেশি জ্বর এবং কিছু অসুস্থতার মতো লক্ষণগুলি সর্বচ্চ তিন দিন স্থায়ী হয়েছিল এবং মৃত্যুর হারও সাধারন ফ্লুর মতোই ছিল।
ভাইরাস নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি পড়তে পারেন এখান থেকে।
আরও পড়ুনঃ- স্প্যানিশ ফ্লু (Spanish Flu) এবং উনবিংশ শতাব্দীর ভয়াবহতা
স্প্যানিশ ফ্লুর দ্বিতীয় প্রকোপ
১৯১৮ সালের গ্রীষ্মে স্প্যানিশ ফ্লুর প্রবনতা অনেকটাই কমে গিয়েছিল, তবে আগস্টের শুরুতে ভাইরাসটি নতুনভাবে দেখা দিতে পারে, এরকম একটি আশঙ্কা আধিকারিকদের মধ্যে ছিল। আসলে প্রচন্ড ঝড় শুরু হওয়ার আগে প্রকৃতি যেমন শান্ত থাকে, ফ্লুর অবস্থাও অনেকটা সেরকম ছিল।
ইউরোপের কোথাও কোথাও, স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসের একটি পরিবর্তিত স্ট্রেন উপস্থিত হয়েছিল সে সময় যা সংক্রমণের প্রথম লক্ষণগুলি দেখার ২৪ ঘন্টার মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ একজন যুবক বা মহিলাকে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে।
১৯১৮ সালের আগস্টের শেষের দিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে, সামরিক জাহাজগুলি ইংলিশ বন্দর প্লাইমাউথ থেকে স্প্যানিশ ফ্লুর এই নতুন এবং অত্যন্ত মারাত্মক স্ট্রেনটি অজান্তেই সৈন্যদের মধ্যে সংক্রামিত হয় এবং তারা এটিকে তাদের নিজেদের দেশে নিয়ে যায়। এই জাহাজগুলি ফ্রান্সের ব্রেস্ট, যুক্তরাষ্ট্রে বোস্টন এবং পশ্চিম আফ্রিকার ফ্রিটাউনের মতো শহরে পৌঁছে বিশ্বব্যাপী মহামারীর দ্বিতীয় ধাপের সূচনা করেছিলো।
“সংক্রামক রোগ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উভয় বিষয়েই অভিজ্ঞ ওহিও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ জেমস হ্যারিস বলেছেন,” বিশ্বজুড়ে সৈন্যদের দ্রুত চলাচল এই রোগের একটি বড় প্রসারণকারী ছিল। ” জনাকীর্ণ পরিস্থিতিতে মহামারী যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে অবশ্যই যুদ্ধ ফেরত সেনাদের একটি বিশাল ভুমিকা ছিল।
ভাইরাসটি তরুণ এবং বৃদ্ধ উভয়কেই সংক্রামিত করেছিলো
১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত স্প্যানিশ ফ্লুর মৃত্যুর হার ছিল আকাশ ছোঁয়া। কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, অক্টোবরের মাসে স্প্যানিশ ফ্লুতে ১,৯৫,০০০ আমেরিকান মারা গিয়েছিল। একটি সাধারণ মৌসুমী ফ্লু, যা বেশিরভাগই শিশু এবং খুব বৃদ্ধদের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু,স্প্যানিশ ফ্লুর দ্বিতীয় আঘাত “ডাব্লু কার্ভ” নামে পরিচিত হয়েছিলো এবং এটি যুবক এবং বৃদ্ধদের মধ্যে বহু সংখ্যক মৃত্যুর ঘটনা ঘটায়।
বিশ্বব্যাপী শুধুমাত্র লক্ষ লক্ষ সুস্থ যুবক-যুবতী মারা যাচ্ছিল তাই নয়, তারা কীভাবে মারা যাচ্ছিল সেটাও অবাক করা বিষয় ছিল। ফোসকা, অনুনাসিক রক্তক্ষরণ এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ফুস্ফুসে এক ধরনের তরল জমছিলো, যা দ্রুত মৃত্যু ঘটানোর ক্ষেত্রে বড় ভুমিকা পালন করেছিলো।
এর কয়েক দশক পরে বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাটির একটি ব্যাখ্যা দাড় করাতে পেরেছিলেন যা বর্তমানে “সাইটোকাইন বিস্ফোরণ” (cytokine explosion) নামে পরিচিত। যখন মানুষের শরীর কোনও ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের প্রতিরোধ ব্যাবস্থা সাইটোকাইন নামে একধরনের ম্যাসেঞ্জার প্রোটিন প্রেরণ করে।
তবে ফ্লুর কিছু বিশেষ স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, বিশেষত এইচ 1 এন 1 ভাইরাসের প্রভাব স্প্যানিশ ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী ছিল। এই বিষয়গুলি, দেহকে সাইটোকাইন এর দ্বারা অতিরিক্ত চাপ দেওয়া হয়, যার ফলে দেহে মারাত্মক প্রদাহের সৃষ্টি হয়, ফলে ফুসফুসে এক ধরণের তরলের মারাত্মক উত্থান ঘটে।
ব্রিটিশ সামরিক চিকিত্সকরা স্প্যানিশ ফ্লুর এই দ্বিতীয় আঘাতে নিহত সৈন্যদের ময়না তদন্ত করেছিলেন। সে সময় তারা দেখতে পান, রাসায়নিক যুদ্ধের সময় মৃতদেহে যে লক্ষন দেখা যায়, ঠিক তেমনি আক্রান্তদের ফুসফুসে সেই একই ধরণের লক্ষন দেখছিলেন তারা।
কোয়ারানটাইনের অভাবে ফ্লু ছড়িয়ে পড়ে এবং বাড়তে দিয়েছিলো
সে সময়ের সামরিক কর্মকর্তারা স্প্যানিশ ফ্লুটির দ্রুত প্রসারণটি যুদ্ধ পরবর্তী সেনা পৃথকীকরণের জন্য যে ঘটেছে সেটা বিশ্বাস করতে চাননি। তাই জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ঠিক সে সময় ব্রিটেনে আর্থার নিউশোলমে নামে একজন সরকারী কর্মকর্তা, পুরোপুরি ভাল করেই জানতেন যে কঠোর বেসামরিক লকডাউনই অত্যন্ত সংক্রামক রোগের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পক্ষে একমাত্র সেরা উপায়। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অব্যাবস্থাপনার কারনে রোগীদের যথাযথ নার্সিংয়ের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিয়েছিলো।
আমেরিকান রেড ক্রসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফ্রিকান আমেরিকান নার্সদের ব্যবহার না করা পর্যন্ত এই সংকট আরও খারাপ হয়েছিল, কিন্তু ততোক্ষণে পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে গেছে।
আরও পড়ুনঃ- ইবোলা ভাইরাস (ebola virus) কি? ইবোলা ভাইরাসের গঠন প্রকৃতি
চিকিত্সা সরঞ্জামের অভাব
১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু যে এত বেশি লোকের জীবন হরণ করেছিল তার অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল বিজ্ঞানের কাছে ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য একটি ভ্যাকসিন তৈরির কোন প্রকার সরঞ্জাম ছিল না।
ভাইরাসের মতো অবিশ্বাস্যরকম ছোট কিছু দেখার পক্ষে সঠিক মাইক্রোস্কোপ ১৯৩০ এর আগে আবিষ্কারই হয়েছিলো না। ফলে, ১৯১৮-এর সময়কার শীর্ষ পেশাদার চিকিৎসকরা এটা নিশ্চিত করেছিলেন যে ফ্লুটি “পিফাইফার্স ব্যাকিলিয়াস” নামে একটি জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট হয়েছিল।
১৮৯০ সালে বিশ্বব্যাপী ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের পরে, রিচার্ড ফেফার নামে একজন জার্মান চিকিত্সক আবিষ্কার করেছিলেন যে, ফ্লুর দ্বারা তাঁর সমস্ত সংক্রামিত রোগীই সাধারণত এইচ ইনফ্লুয়েঞ্জা নামে পরিচিত ব্যাকটিরিয়ার একটি বিশেষ স্ট্রেন বহন করেছিলেন।
স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী যখন আঘাত হানাছিল, তখন বিজ্ঞানীরা “পিফাইফার্স ব্যাকিলিয়াস” (Pfeiffer’s bacillus) নিরাময়ের চেস্টা চালাচ্ছিলেন। এইচ। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য এবং তার চিকিত্সার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অত্যাধুনিক ল্যাবগুলিতে বিনিয়োগ করা হয়েছিল, কিন্তু কিছুই ফলে আসেনি।
হ্যারিস বলেছেন “এটি চিকিত্সা বিজ্ঞানের জন্য তখন একটি বিশাল বিভ্রান্তি ছিল,” ।
১৯১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্প্যানিশ ফ্লুর মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউয়ের সমাপ্তি হতে চলেছিল, তবে এর ইনফ্লুঞ্জা মহামারীটির হাত ছিল অনেক প্রসারিত। ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ায়, এর একটি প্রাদুর্ভাব (তৃতীয় তরঙ্গ) পুনরায় শুরু হয়েছিল এবং আবারো ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসেছিলো।
অনেকেই এটা বিশ্বাস করেন, রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন ১৯১৯ সালের এপ্রিলে প্যারিসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শান্তির আলোচনার সময় স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
স্প্যানিশ ফ্লুর তৃতীয় ধাক্কায় মৃত্যুর হার দ্বিতীয়টির মতোই ব্যাপক ছিল। অনেক বিচার বিশ্লেষণ এর পড়ে, এটাই মনে করা হয়েছিলো যে ১৯১৮ সালের নভেম্বরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান মূলত এমন পরিস্থিতি ডেকে নিয়ে এসেছিলো এবং রোগটিকে এতদূর এবং এত দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো।
তথ্যসূত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/Spanish_flu
https://www.history.com/news/spanish-flu-second-wave-resurgence
https://virus.stanford.edu/uda/