পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ রয়েছে, যাদের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। পৃথিবীর প্রাচীনতম দেশ সম্পর্কে আপনি ইন্টারনেট ঘাটলে এমন অনেক দীর্ঘ একটি ইতিহাস সমৃদ্ধ দেশ খুব সহজেই পেয়ে যাবেন। কিন্তু আপনি যদি সুনির্দিষ্টভাবে এটা খোঁজেন যে, এ দেশগুলোর মধ্যে কোন দেশটি সবচেয়ে প্রাচীন।
তাহলে আপনি কিছুটা ধাঁধায় পড়তে পারেন। তাই প্রাচীনতম দেশ নির্ধারণ করার পূর্বে আপনাকে প্রথমে দেশ এবং সাম্রাজ্যের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করতে হবে। কারন এ দুটির মধ্যে পার্থক্য না খুঁজলে এখান থেকে খুব ভালো একটি জবাব খুঁজে নাও পেতে পারেন।
সাম্রাজ্য এবং দেশের মধ্যে পার্থক্য
সাম্রাজ্যকে যদি আপনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করেন, তবে দেখবেন এর পরিধি অনেক বিস্তৃত এবং অনেক বড় একটি অঞ্চল জুড়ে এটি বিদ্যমান। কিন্তু কোন একটি দেশের রয়েছে নিজস্ব অঞ্চল, জনসংখ্যা এবং সরকার নিয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র ব্যাবস্থা।
সাম্রাজ্য এবং দেশের মধ্যে অন্যতম প্রধান পার্থক্য হ’ল, দেশের রয়েছে স্বতন্ত্র এবং অন্যন্য সত্তা। সেই সাথে সাম্রাজ্যের রয়েছে ভৌগলিকভাবে কম সুনির্দিষ্ট অঞ্চল। সাম্রাজ্য অনেক গুলো দেশ নিয়ে হতে পারে এবং এর অনেকগুলো সরকার থাকতে পারে এবং সেটা পরিলক্ষিতও হয়েছে।
সাম্রাজ্য (Empire)
প্রাচীন চীন, জাপান, ইরান (পার্সিয়া), গ্রীস, রোম, মিশর, কোরিয়া, মেক্সিকো এবং ভারতের দিকে যদি তাকান তবে দেখতে পাবেন ইতিহাসে এসব অঞ্চলে সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। এসব সাম্রাজ্যর নিজস্ব শক্তি এতটাই ছিল যে, বর্তমানে আমরা আজ এই অঞ্চলের দেশগুলিকে যেভাবে জানি, সেটা অতীতে চিন্তাই করা যেত না।
এসব সাম্রাজ্যের প্রাথমিক নামগুলো এদের আধুনিক নামের সাথে কোনভাবেই সম্পর্কিত ছিল না। সাম্রাজ্যগুলোর কেন্দ্রীয় সরকার তাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চলগুলোতে তাদের শাসন কায়েম করেছিল।
প্রাচীন সাম্রাজ্যের অবয়ব মূলত নগর-রাজ্য বা ফিফডমদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল এবং এর অধিক্ষেত্রটি সাম্রাজ্যবাদী সরকারের অধীনে ছিল। একটি সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অঞ্চল সাধারণত অস্থায়ী, যে কারনে এসব অঞ্চলে প্রায়শই যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকতো। রাজতন্ত্রের বিদ্রোহ ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।
এ কারণে, অনেক নগর-রাজ্যগুলি একই সাম্রাজ্যের অংশ হিসাবে বিবেচিত হলেও, তারা একীভূত সত্তা হিসাবে সেভাবে কখনোই কাজ করতো না।
আরও পড়ুনঃ- পৃথিবীর মোট দেশের সংখ্যা কত? মহাদেশীয় অঞ্চল ভিত্তিক দেশের সংখ্যা এবং তাদের নাম
দেশ (Country)
সাম্রাজ্যগুলো আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র বা সার্বভৌম দেশের ধারণা থেকে অনেক দূরে ছিল। উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে বিভিন্ন দেশ জাতি-রাষ্ট্র বা সার্বভৌমত্ত্বের ধারণা নিয়ে নিজেদের আবির্ভূত করেছিল। এবং এ জন্যই হয়তো দুটি সত্তা দীর্ঘকাল সহাবস্থান করতে পারেনি। আসলে, এ সময় অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় একটি সাম্রাজ্যের পতন একটি জাতি-রাষ্ট্রের সূচনা হিসেবে পরিণত হয়েছিল।
এটা ভাবা একেবারেই সঠিক হবে যে, আজকের দেশ বা রাষ্ট্রগুলো সাম্রাজ্যের বিলোপ থেকেই শুরু হয়েছিল। সাধারণ ভৌগলিক অবস্থা, ভাষা এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ধারা এমন সম্প্রদায়ের জন্য কোন একটি দেশ গঠনের ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক হয়েছিলো।
শেষ পর্যন্ত, সাম্রাজ্যর ধারণা থেকে এমন অনেক দেশই তাদের অগ্রযাত্রা শুরু করেছিল, কিন্তু সবচেয়ে প্রাচীন দেশ কোনটি সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে আমরা নিচের যে তিনটি দেশ সম্পর্কে আলোচনা করতে যাচ্ছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এদের বিশ্বের প্রাচীনতম দেশ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
সান ম্যারিনো (San Marino)
বিভিন্ন ঐতিহাসিকের বহু বিবরণে উঠে এসেছে, বিশ্বের অন্যতম ক্ষুদ্র দেশ প্রজাতন্ত্রীক সান ম্যারিনো বিশ্বের প্রাচীনতম দেশ। ইতালির দ্বারা পুরোপুরি ল্যান্ডলক(landlocked) এই ক্ষুদ্র দেশটি খ্রিস্টপূর্ব ৩০১ আব্দের ৩ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মাউন্ট টাইটানোর শীর্ষে অবস্থিত একটি বিহার, সম্ভবত এখানকার কোন একটি সম্প্রদায়ের কেন্দ্র হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। যাইহোক, ১৬৩১ সালের পূর্বে এ স্থানটি বা জাতি পোপ দ্বারা স্বীকৃত কোন জাতি ছিল না।
সান মেরিনোর স্বাধীনতা উঁচু, পাহাড়ী অঞ্চলের বিভিন্ন দুর্গগুলির মধ্যে বিচ্ছিন্ন ভাবে অবস্থান করছিল। সান মেরিনোর সংবিধান, ১৬০০ সালে রচিত হয়, এবং এটিকে বিশ্বের প্রাচীনতম সংবিধান হিসেবে ধরা হয়।
জাপান (Japan)
সাম্রাজ্য এবং দেশ উভয় হিসাবে জাপানের ইতিহাস অনেকটা বিভ্রান্তিকর হতে পারে অনেকের কাছে। জাপানের ইতিহাস অনুসারে, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট, সম্রাট জিম্মু খ্রিস্টপূর্ব ৬৬০ সালে জাপান দেশটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে খ্রিস্টীয় কমপক্ষে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত জাপানিজ সংস্কৃতি ও বৌদ্ধধর্ম দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল।
দীর্ঘ ইতিহাসের পরে, জাপান বিভিন্ন ধরণের সরকার এবং নেতাদের শাসন দেখেছে। দেশটি প্রতিষ্ঠার বছর হিসাবে খ্রিস্টপূর্ব ৬৬০ খ্রিস্টাব্দ উদযাপন করলেও ১৮৬৮ সালের মেইজি পুনরুত্থান না হওয়া পর্যন্ত আধুনিক জাপানের আত্মপ্রকাশ ঘটে নি।
চীন (China)
বিশ্বের প্রাচীনতম দেশ এর তালিকায় চীন রয়েছে খুব ভালো অবস্থানে। চীনা ইতিহাসে প্রথম রাজবংশের অস্তিত্ব ছিল প্রায় ৩৫০০ বছর আগে। যখন সামন্ত শ্যাং রাজবংশ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করেছিল। যাইহোক, আধুনিক চীন ২২১ খ্রিস্টপূর্বে প্রতিষ্ঠার তারিখ হিসাবে উদযাপন করে, যে বছর কিন শি হুয়াং নিজেকে চিনের প্রথম সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন।
তবে চীন আরও অনেক পরিবর্তন ও রাজবংশের শাসন, ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে আজকের চীন দেশে পরিণত হয়েছে।
খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে হান রাজবংশ, চীনা সংস্কৃতি ও .ঐতিহ্যকে একীভূত করেছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, মঙ্গোলরা চীন আক্রমণ করে এবং এর জনসংখ্যা ও সংস্কৃতির বহু নিদর্শন ধ্বংস করেছিল। ১৯১২ সালে বিপ্লব চলাকালে চীনা প্রজাতন্ত্রের উত্থানের ফলে চীনের কিং রাজবংশের পতন ঘটে।
অবশেষে, ১৯৪৯ সালে চীনা প্রজাতন্ত্র নিজেই মাও সে তুংয়ের কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের দ্বারা উৎখাত হয়েছিল এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তার যাত্রা শুরু করেছিল।
আরও পড়ুনঃ- পৃথিবীতে প্রকৃত পক্ষে মোট দেশের সংখ্যা কত ?(বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ)
আরও পুরানো কিছু দেশ
চীন, জাপান অথবা সান ম্যারিনোর অনেক পুরাতন ইতিহাস থাকলেও সমকালীন সময়গুলোতে আরও কিছু দেশের উদ্ভব হয়েছিলো, যাদের রয়েছে একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ইতিহাস। যখন আপনি মিশর, ইরাক, ইরান, গ্রীস এবং ভারতের মতো আধুনিক দেশগুলোর দিকে তাকাবেন, দেখবেন তাদের প্রাচীন ইতিহাসের সাথে বর্তমানের এত সামান্য মিল রয়েছে যে তাদের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান গুলোকে সাম্প্রতিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
এই দেশগুলোর অনেকগুলোই তাদের আধুনিক চিন্তাধারাকে উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে, আর এজন্যই মূলত এ দেশগুলোকে খুব পুরাতন দেশের তালিকায় স্থান দেয়া হয় না।
তবে যাইহোক, এছাড়াও এমন কিছু আধুনিক দেশ রয়েছে, যারা তাদের প্রাচীন ইতিহাকে মুছে ফেলেনি। এখনো এদের শিকড়গুলোর গভীরতা আমাদের অনেক পিছনের ইতিহাসকে ট্রেস করতে সাহায্য করতে পারে। তো চলুন দেখে আসি বিশ্বের প্রাচীনতম দেশের তালিকায় আরও কোন দেশগুলো রয়েছে।
- প্রথমে আসছে ফ্রান্স এর নাম এবং ৮৪৪ খ্রিষ্ঠাব্দকে এর প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে ধরা হয়।
- দ্বিতীয় নামটি অস্ট্রিয়া। ৯৭৬ খ্রিষ্ঠাব্দকে অস্ট্রিয়ার প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে ধরা হয়।
- হাঙ্গেরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১০০১ খ্রিষ্ঠাব্দে।
- থাইল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১২৩৮ খ্রিষ্ঠাব্দে।
- সুইজারল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১২৯১ খ্রিষ্ঠাব্দে।
তথ্যসূত্রঃ- https://www.thoughtco.com/oldest-country-in-the-world-1435395
https://www.oldest.org/geography/countries/
https://theculturetrip.com/europe/greece/articles/the-oldest-countries-and-nations-in-the-world/