ক্যাপস ছিল হিটলারের এসএস বাহিনী কর্তৃক নির্বাচিত “একপ্রকার কার্যকরী বন্দী”। এ নামটি জার্মান শব্দ Funktionshäftling থেকে এসেছে। ক্যাপস’রা ছিল সেই ধরণের বন্দী যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের সাথে একই নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প (concentration camp) এ অন্য বন্দীদের উপরে অত্যাচারের নেতৃত্ব বা প্রশাসনিক ভূমিকা পালন করার জন্য সহযোগিতা করতো।
পুরো ইউরোপ জুড়ে নাৎসিদের নির্মিত ৪২,০০০ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে এ রকম হাজার হাজার ক্যাপস কাজ করতো এবং সেটা ছিল অবশ্যই তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
নাৎসিরা যেভাবে কাপোসদের ব্যবহার করেছিল
জার্মান অধিকৃত ইউরোপে নাৎসি concentration camp এর সার্বিক ব্যবস্থাপনা এসএস (শুটজস্টাফেল) এর নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং যার প্রধান ছিলেন হাইনরিখ হিমলার। শিবিরগুলিতে কর্মরত অনেক এসএস সদস্য বসবাসকালীন সময়ে তাদের সহকারী হিসেবে একপ্রকার বন্দীদেরকে কিছুটা উঁচু পদে নিয়োগ করেছিল। এই উচ্চ পদে থাকার জন্য নির্বাচিত বন্দীরাই মূলত কাপোসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলো সে সময়।
“ক্যাপস শব্দটির উত্স “সুস্পষ্ট নয়” এমন। কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, এটি সরাসরি ইতালিয়ান শব্দ “ক্যাপো” থেকে জার্মান ভাষায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। আবার অনেক জার্মান এবং ফরাসী, উভয় শব্দ হিসেবেই একে দেখে থাকে। নাৎসি কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলিতে কাপো শব্দটি প্রথম ডাকাউতে ব্যবহৃত হয় এবং পরবর্তীতে অন্যান্য শিবিরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
ক্যাপসরা নাৎসিদের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, কারণ এখানে বিপুল সংখ্যক কয়েদীকে নিয়মিত তদারকির প্রয়োজন ছিল। বেশিরভাগ ক্যাপসকে সান্ডারকম্যান্ডো নামে একটি বন্দী ওয়ার্কের দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। তাদের কাজ ছিল বন্দীদের অসুস্থ ও অনাহারে থাকা সত্ত্বেও নির্মমভাবে জোর করে কঠিন পরিশ্রমের কাজ করতে বাধ্য করা।
বস্তুত বন্দীদের একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য এসএসের পক্ষে এ ক্যাপস নিয়োগের বিষয়টি ছিল একটি কৌশল। একই সাথে বিভিন্ন গ্রুপের বন্দীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি এবং উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়ে তাদের শ্রমের প্রয়োজন মেটানো ছিল একটি বড় উদ্দেশ্য।
কাপোসদের নিষ্ঠুরতা
কাপোসরা অনেক ক্ষেত্রে, নিজেরাই এসএসের চেয়ে অনেক বেশি অত্যাচারী ছিল। তাদের অবস্থান এসএস নেতৃত্তের কাছে সুস্পষ্ট করা এবং তাদের সন্তুষ্টি লাভের আশায়, অনেক কাপোস তাদের সহযোগী বন্দীদের বিরুদ্ধে চরম হিংসাত্মক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলো।
সহিংস অপরাধমূলক আচরণের জন্য বন্দীদের মধ্য থেকে বেশিরভাগ কাপোসকে নিয়োগ দেয়া হতো, যার ফলে এই নিষ্ঠুরতা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বেঁচে থাকার স্মৃতি মনে করতে সক্ষম এমন কিছু কাপোসের সাথে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে প্রিমো লেভি এবং ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেছিলেন। এটি ছিল নির্দিষ্ট কিছু কাপোসের বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে তৈরি একটি প্রামাণ্য চিত্র। সেখান থেকে যা উঠে এসেছিলো তার নিষ্ঠুরতা বর্ণনার অযোগ্য।
আউশভিটস কনসেন্ট্রেশন শিবিরের উইজেল নামে এক বন্দির উপর, ইদেক, নামে একজন নিষ্ঠুর কাপোসের নিষ্ঠুরতা বিষয়ে এখানে দেখানো হয়। সেই রাতের বর্ণনা ছিল এরকম,
“একদিন ইদেক যখন তার ক্রোধের প্রতিশোধ নিচ্ছিল, তখন আমি সেই স্থানটি অতিক্রম করার চেষ্টা করি। এ সময় তিনি আমার দিকে খেয়াল করলেন এবং তিনি নিজেকে যেন বুনো জন্তুর মতো ছুঁড়ে মারলেন আমার দিকে। আমার বুকে, আমার মাথায় আঘাত করলেন, আমাকে মাটিতে ফেলে দিলেন এবং আমাকে আবার তুলে আছার মারতে থাকলেন। আমাকে রক্তাক্ত হতে না দেওয়া পর্যন্ত আমাকে আরও বেশি হিংস্র ভাবে আঘাত করে গিয়েছিলেন তিনি। আমি মুখ বুজে ব্যাথা সহ্য করেছি, তাই তিনি আমাকে আরও কঠোর করে মারতে থাকলেন। হঠাৎ করেই সে শান্ত হয়ে আমাকে আবার কাজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তার ভাবটি এমন ছিল যেন কিছুই হয়নি।”
Man’s Search for Meaning গ্রন্থের লেখক ফ্র্যাঙ্কল এমন একজন কাপোসের কথা বলেছেন যিনি “দ্য মার্ডারাস ক্যাপো” নামে পরিচিত ছিলেন তার নিষ্ঠুরতার জন্য।
কাপোসেদের অধিকার
শিবির ভেদে কাপোস হওয়ার সুযোগ সুবিধা আলাদা ছিল, তবে প্রায়শই সর্বদা উন্নত জীবনযাপন এবং শারীরিক শ্রমের ক্ষেত্রে কার্পণ্যতা ছিল না। আউশভিটসের মতো বৃহত্তর শিবিরগুলিতে কাপোসরা বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ব্যারাকের মধ্যে পৃথক কক্ষ পেয়েছিলেন, যা তারা প্রায়শই একটি স্ব-নির্বাচিত সহকারীদের সাথে ভাগ করে নিত।
অনেক কাপোসই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের পরিবর্তে আরও ভাল পোশাক, আরও ভাল রেশন এবং শ্রমের তদারকি করার ক্ষমতা পেয়েছিল। কিছু কাপোস কখনও কখনও শিবিরের ব্যবস্থায় যেমন সিগারেট, বিশেষ খাবার এবং অ্যালকোহল জাতীয় বিশেষ আইটেম সংগ্রহ করতে তাদের প্রভাব ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বৃহৎ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে, “কাপো” পদবিতে বিভিন্ন শ্রেণী ব্যাবস্থা বিদ্যমান ছিল। কাপোস হিসাবে বিবেচিত বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে,
লেজারলিস্টেটার (শিবিরের নেতা); আউশ্ভিটস-বারকেনোর মতো বড় বড় শিবিরের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে, লেজারলিস্টেটার পুরো বিভাগটি তদারকি করার ক্ষমতা লাভ করেছিল এবং প্রশাসনিক ভূমিকাতে উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল তাদের। এরা সমস্ত বন্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ এবং সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতো।
ব্লকএল্টেস্টার (ব্লক লিডার): বেশিরভাগ শিবিরে এ স্তরটি বেশি প্রচলিত ছিল। ব্লকএল্টেস্টার পুরো ব্যারাকের প্রশাসন এবং শৃঙ্খলার দায়িত্বে ছিলেন। এরা প্রথাগতভাবে একটি প্রাইভেট রুম (একজন সহকারীর সাথে ভাগ করে নেওয়া) এবং ভাল রেশন ব্যাবস্থার আওতায় ছিল।
স্টুবেনেস্টেস্ট (বিভাগের নেতা): আউশ্ভিটস-এর মতো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বড় ব্যারাকেগুলির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এদের হাতে থাকতো। সেই সাথে ব্যারাকের বন্দীদের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ব্লকলেটটেষ্টারের কাছে রিপোর্ট করা হতো।
আরও পড়ুনঃ- হলোকাস্ট!(Holocaust) ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়।
কাপসদের মুক্তি
যুদ্ধরত মার্কিন সামরিক পরীক্ষার অংশ হিসাবে কয়েকজন ক্যাপসকে যুদ্ধ-উত্তর পশ্চিম জার্মানিতে বিচারের মুখোমুখি হয়েছিল। ১৯৬০-এর দশকে আউশভিটসের একটি মামলায় দুজন কাপোসকে হত্যা ও নিষ্ঠুরতার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
ক্যাম্পগুলোর মুক্তি লাভের পরে, বেশ কিছু ক্যাপসকে পূর্ব জার্মানি এবং পোল্যান্ডে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু এতে খুব বেশি সফলতা পাওয়া যায়নি। কাপোসদের বিচারের জন্য একমাত্র আদালত গঠন করা হয়েছিলো। অনুমোদিত এ আদালতে তাদের যুদ্ধ-পরবর্তী বিচারে হয়েছিল। সেখানে সাতজন কাপসের মধ্যে ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
ঐতিহাসিক এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা নাৎসি যুগে প্রকাশিত উপলভ্য তথ্য থেকে এখনও কাপোসের ভূমিকা অনুসন্ধান করে চলেছেন। নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ব্যবস্থায় বন্দী কর্মীদের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অনেকেই কাপোসদের সুযোগ সন্ধানী এবং সুবিধবাদী হিসেবে দেখে থাকেন, তবে বেঁচে থাকার জন্য এতটুকু সুবিধাবাদী হওয়া খুব একটা অপরাধ হয়তো নয়। তবে একটা বিষয় সত্যি যে, তাদের সম্পূর্ণ ইতিহাস কখনও জানা সম্ভব নয়।
তথ্যসূত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/Kapo_(concentration_camp)
https://www.theholocaustexplained.org/the-camps/ss-concentration-camp-system/who-was-in-charge-at-the-ss-camps/
https://www.thoughtco.com/kapos-prisoner-supervisors-1779685